মব সন্ত্রাসে বাবা রূপলাল রবিদাসকে হারিয়ে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল জয় রবি দাসকে। পরিবারের আয়ের সংস্থান করতে ১৪ বছরের এই কিশোরকে বাবার পেশা জুতা সেলাইয়ের কাজে নামতে হয়েছিল। তবে মানুষের সহমর্মিতা ও সহযোগিতায় আবারও স্কুলে ফিরেছে সে। বাবাহীন সংসারের বোঝা ঝেড়ে এখন তার কাঁধে উঠেছে বইয়ের ব্যাগ। স্বপ্ন— বড় হয়ে আইনজীবী হওয়া।
তারাগঞ্জ বাজারে নতুন চৌপথী বাসস্ট্যান্ড থেকে অগ্রণী ব্যাংক মোড়ের মধ্যবর্তী স্থানে জুতাপট্টির সামনে রাস্তার পাশে জলচৌকিতে বসে জুতা সেলাই করতেন জয়ের বাবা রূপলাল রবিদাস। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে একই পেশা বেছে নেয় একমাত্র ছেলে জয়।
জানা গেছে, চৌদ্দ বছর বয়সী জয় রবি দাস রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের বাসিন্দা। সে তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। তার বড় বোন নুপুর দাস এইচএসসি পাস করেছেন। ছোট বোন রূপা দাস পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে।
গত ৯ আগস্ট চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হন রূপলাল রবিদাস ও তার ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লাল রবিদাস। বাবাকে হারিয়ে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়ে ফুটপাতে কাঠের চৌকিতে বসে জুতা সেলাই শুরু করে জয়। সেখানে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কাজ করতেন তার বাবা। এ খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সহমর্মিতা জানিয়ে এগিয়ে আসে অনেকেই। প্রশাসনের আশ্বাসে নতুন ভরসা পেয়ে জয় আবার ফিরেছে স্কুলে। গত রোববার থেকে সে নিয়মিত ক্লাস করছে। বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার।
জয় রবি দাস বলে, ‘আমি নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছি। শিক্ষক-সহপাঠী সবাই উৎসাহ দিচ্ছে, সাহায্য করছে। এখন আমাকে আর জুতা সেলাইয়ের কাজ করতে হচ্ছে না। বাবার স্বপ্ন পূরণে আমি আইনজীবী হতে চাই।’
জয় আরও বলে, ‘বাবার আসনে বসে প্রথমদিন কাজ করার সময় বুক ফেঁটে কান্না এসেছিল। কিন্তু কাঁদতে পারিনি। বাবাকে হারানোর কষ্ট ভুলতে পারছি না। বাবাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মেরে ফেলায় আমরা এতিম হয়ে গেছি। বাড়িতে আমার দাদি, মা ও দুই বোন রয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর উপজেলা প্রশাসন এক লাখ টাকা দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতসহ অনেকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। আমরা সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।’
তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু মুসা বলেন, ‘জয় মেধাবী ছাত্র। বাবাকে হারানোর পর সে স্কুলে আসা বন্ধ করেছিল। হঠাৎ রাস্তায় তাকে জুতা সেলাই করতে দেখে মন খারাপ হয়েছিল। এখন সে আবার বিদ্যালয়ে আসছে, তাকে দেখে ভালো লাগছে। আমরা মানসিকসহ সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছি।’
রংপুর তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল রানা বলেন, ‘পরিবারটি সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেয়েছে। রূপলালের বড় মেয়ে নুপুরের জন্য একটি চাকরি ও বাজারে দোকানঘর করে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা যাতে ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, গত ৯ আগস্ট রাত সাড়ে ৮টার দিকে মিঠাপুকুরের ছড়ান বালুয়া এলাকা থেকে ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লালকে নিয়ে ভ্যানে বাড়ি ফেরার পথে তারাগঞ্জের সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা মোড়ে কয়েকজন ব্যক্তি তাদের আটক করে। চোর সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে প্রদীপ লালের কালো ব্যাগে ‘স্পিড ক্যানের’ বোতলে দুর্গন্ধযুক্ত পানীয় ও কিছু ওষুধ পাওয়া যায়। বোতলের ঢাকনা খোলার পর দুর্গন্ধে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে উত্তেজিত হয়ে স্থানীয়রা রূপলাল ও প্রদীপ লালকে বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে যায় এবং লাঠিসোঁটা ও লোহার রড দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে প্রদীপ লালকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে পরদিন রোববার ভোরে সেও মারা যায়।
ঘটনার পরদিন ১০ আগস্ট নিহত রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে তারাগঞ্জ থানায় ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এখন পর্যন্ত মামলায় ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।